পবিত্র রমজান মাস মুসলিম সমাজের জন্য এক মহিমান্বিত সময়। এটি কেবল সিয়াম বা রোজা রাখার মাসই নয়, বরং একটি আধ্যাত্মিক অভ্যুত্থানের সময়, যা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে সঠিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। রমজানের মাসটি তাই শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে এটি সহনশীলতা ও সম্প্রীতি বৃদ্ধিতে এক অমূল্য ভূমিকা পালন করে। রমজানের সময় মানুষের মধ্যে সহানুভূতি, ত্যাগ, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা এবং মহান রবের প্রতি নির্ভরশীলতার অনুভূতি গভীরভাবে বৃদ্ধি পায়, যা সমাজে সাম্প্রদায়িক শান্তি এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
রমজান মুসলিম ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাস। এই মাসে আল্লাহ তাআলা মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় মহাগ্রন্থ আল কুরআন অবতীর্ণ করেছেন এবং এই মাসের রোজা রাখাকে ইসলামের একটি স্তম্ভ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। পবিত্র রমজান কেবল সিয়াম পালন কিংবা ইবাদত করার একটি সময় নয়, এটি আত্মিক উন্নতি, পরিশুদ্ধতা এবং সহানুভূতির সময়। ইসলামে সিয়াম বা রোজা শুধুমাত্র খাবার বা পানীয় থেকে বিরত থাকার নির্দেশ নয়, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়া। রোজা রাখার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার আত্মাকে শুদ্ধ করে, তার মন ও শরীরকে পরিশুদ্ধ করে এবং মহান আল্লাহর কাছ থেকে তার ক্ষমা প্রার্থনা করে।
রোজা রাখার মাধ্যমে মুসলমানরা শিখে যে, মানুষ যদি পৃথিবীতে তার ক্ষুদ্র ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তবে তার বৃহত্তর লক্ষ্য বা আত্মিক উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে পারে। এটি পরিশ্রম, সহিষ্ণুতা এবং ধৈর্যের এক অনুশীলন। তাই রমজান একজন মুসলমানের জীবনে শুধু একটি আধ্যাত্মিক অবস্থা তৈরি করে না, বরং তাকে তার সামাজিক দায়িত্বের প্রতি আরো বেশি সচেতন করে তোলে। এতে মানুষের মধ্যে সহানুভূতি, দানশীলতা, সহনশীলতা এবং শান্তিবোধ সৃষ্টি হয়।
রমজান মাসে সবচেয়ে বেশি যে মূল্যবোধটি গড়ে উঠে তা হলো সহনশীলতা। রোজা রেখে মুসলমানরা খাবার, পানীয় ও শারীরিক সুখ-সুবিধা থেকে বিরত থাকে, যা তাদের সহিষ্ণুতা এবং ধৈর্য বৃদ্ধি করে। মানুষের এই ধৈর্যশক্তি শুধুমাত্র তার আত্মবিশ্বাস এবং আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য নয়, বরং এটি তার সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক বিরাট ভূমিকা পালন করে। যখন কোনো ব্যক্তি সিয়াম পালন করে, তখন তার অন্তরে সহনশীলতা বৃদ্ধি পায়, যা পরবর্তীতে তার পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী, বন্ধু এবং অন্যান্য মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়তে সাহায্য করে। সহনশীলতা রমজানের গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা, যা ব্যক্তির মাঝে দয়া, সহানুভূতি এবং অন্যের প্রতি সহানুভূতি জাগ্রত করে।
এছাড়াও রমজান মাসে মুসলিমরা নিয়মিতভাবে দান-খয়রাত করে থাকে, যা তাদের মধ্যে পরোপকারের মনোভাব বৃদ্ধি করে এবং অন্যের প্রতি সহানুভূতি ও সহনশীলতা বাড়ায়। দানশীলতা শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির আত্মিক উন্নতিই সাধন করে না, এটি সমাজে বিপন্ন ও অসহায়দের প্রতি সহানুভূতির অনুভূতি জাগ্রত করে। এই দানশীলতার মাধ্যমে সামাজিক সাম্যতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
রমজান মাস শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্যই নয়, সারা বিশ্বের মানবতার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নিয়ে আসে। রোজা রাখার মাধ্যমে মুসলমানরা সব ধরনের অশ্লীলতা, মন্দ কাজ এবং অহঙ্কার থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করে। এতে সমাজে শৃঙ্খলা ও শান্তিময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন: "হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।"(সুরা বাকারা: ১৮৩)।
এই পরহেজগারিতা বা আল্লাহর ভীতি, সমাজে অহিংসা, শান্তি এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রমজান মাসে মুসলমানরা একে অপরকে সহানুভূতি প্রদর্শন করে এবং বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা চাইতে চাইতে আত্মিক উন্নতি লাভ করে। রমজান মাসে এক মুসলমানের মনে অন্য মুসলমানের পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, সৌহার্দ্য এবং সম্প্রীতি গড়ে ওঠে। তারা ঈদের দিনে একে অপরকে ভালোবাসা, দোয়া এবং শুভেচ্ছা জানায়। এই সামাজিক সম্প্রীতি সমাজে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ দূর করে এবং একে অপরকে শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির সাথে জীবনযাপন করতে উৎসাহিত করে।
ইসলামে সন্ত্রাসবাদের কোনো সম্পর্ক নেই । ইসলামে এর কোনো স্থানও নেই। ইসলামে কোনোভাবেই সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে মানুষের ক্ষতি করা অনুমোদিত নয়। একজন মুসলমানের দায়িত্ব হলো, সে যেন অন্যদের ক্ষতি না করে এবং শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে। তাই ইসলামের সঠিক শিক্ষাকে জানলে ও অনুসরণ করলে সহনশীলতা ও সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি হয় এবং বিশ্বময় শান্তি বিরাজ করতে পারে।
রমজান মাস শুধু ইবাদতের মাস নয়, এটি সমাজের জন্য এক শিক্ষার মাস। এই মাসে মানুষের মধ্যে আত্মশুদ্ধি, সহনশীলতা, সম্প্রীতি এবং শান্তিবোধ তৈরি হয়। রোজা রাখার মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করে। এটি সমাজে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। রমজান মানবিক মূল্যবোধ বৃদ্ধিতে একটি অতুলনীয় অবদান রাখে এবং ইসলামিক সমাজের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ঐক্য ও শান্তির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
কবি, লেখক ও গবেষক।
লায়ন মোঃ আবু ছালেহ্ সম্পাদিত ও হাজী জসিম উদ্দিন প্রকাশিত