একুশ শতকের প্রতারণার এক নতুন ফাঁদ হ’ল মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এম.এল.এম ব্যবসা)। এম.এল.এম ব্যবসার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, MLM is like a train with no brakes and no engineer headed full throttle towards a termial. অর্থাৎ ‘সর্বোচ্চ গতিতে স্টেশনমুখী একটি ট্রেনের মত যার কোন ব্রেক নেই, নেই কোন চালক’। ব্রেকবিহীন গাড়ী যেমন যে কোন মুহূর্তে এ্যাকসিডেন্ট করতে পারে, মাঝিবিহীন নৌকা যেমন অপ্রত্যাশিত স্থানে চলে যেতে পারে, মাল্টি লেভেল ব্যবসাও ঠিক তদ্রূপ। যা তার সংজ্ঞা থেকেই জানা যায়। আর বাস্তবতাও তাই। এ প্রতারণার জাজবল্যমান উদাহরণ হ’ল ‘ডেসটিনি-২০০০ প্রাইভেট লিঃ’ ও ‘যুবক’,ইউনিপে টু, অনেক যা অগণিত মানুষের শেষ সম্বলটুকুও চুষে নিয়ে নিঃস্ব করে ছেড়েছে।
একেক ব্যবসার প্রতারণার কৌশল একেক রকম। যেমন পাট ব্যবসায়ীরা শুকনা পাটে পানি দিয়ে ওজন বাড়ায় ও নিম্নমানের পাটে রং মিশিয়ে গুণগত মান বাড়ায়। চাউল ব্যবসায়ীরা মোটা চাউল মেশিনে সরু বানিয়ে তাতে সেন্ট মিশিয়ে নামিদামী চিকন আতপ চাউল বানায়। ফল ব্যবসায়ীরা উপরে ভাল ফল সাজিয়ে রেখে নীচ থেকে খারাপ ও পচা ফল ক্রেতাকে দিয়ে প্রতারণা করে।
ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতারণার আরেক নাম হ’ল দালালী। দালালীর ফলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দালালীর মাধ্যমে কোন জিনিসের দাম ন্যায্য মূল্যের চেয়ে বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেয়া হয়। এমনও দেখা যায় যে, একই ব্যক্তি বিক্রেতার পক্ষেও দালালী করে আবার ক্রেতার পক্ষেও দালালী করে এবং উভয়ের নিকট থেকেই কমিশন গ্রহণ করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দালালীকে নিষিদ্ধ করে বলেছেন, ‘তোমরা দালালী কর না’। জমি, ঘর-বাড়ী, গরু-ছাগল, পাইকারী দ্রব্যসামগ্রী বেচা-কেনায় দালালীর আধিক্য লক্ষ্য করা যায়।
মওজুদদারী, কালোবাজারী, মুনাফাখোরী ইত্যাদি অত্যন্ত ঘৃণিত ও পাপ কাজ। এগুলোর মাধ্যমে বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়, হঠাৎ দ্রব্যের মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে যায়, ক্রয়মূল্য মানুষের সাধ্যের বাইরে চলে যায়। ফলে মানুষের ভোগান্তির শেষ থাকে না। তাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে, সে পাপিষ্ঠ’। অন্যত্র তিনি বলেন, অপরাধী (পাপিষ্ঠ) ব্যক্তি ছাড়া কেউ মওজুদদারী করে না’। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি খাদ্যদ্রব্য ও ঔষধে ভেজাল মেশানো হচ্ছে। মাছ-গোশত, শাক-সবজি, ফলমূল থেকে শুরু করে মানুষের জীবন রক্ষাকারী ঔষধ পর্যন্ত ভেজালে সয়লাভ হয়ে গেছে। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে ‘রিড ফার্মা’ নামের একটি ঔষধ কোম্পানীর ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে ২৭টি শিশু মারা যায়। এছাড়া অনেক কোম্পানীর ট্যাবলেট, ক্যাপসুল তৈরী হচ্ছে আটা-ময়দা বা খড়িমাটি দিয়ে। সিরাপে দেয়া হচ্ছে কেমিক্যাল মিশানো রঙ। এমনকি ‘ভল্টারিন’-এর মত নামকরা ব্যথানাশক ইনজেকশনের অ্যাম্পুলে ভরে দেয়া হচ্ছে স্রেফ ডিস্টিল্ড ওয়াটার। বিভিন্ন নামি-দামী দেশী কোম্পানী এমনকি বিদেশী কোম্পানীর ঔষধও নকল করে চলছে অনেক ঔষধ কোম্পানী লেভেল ও বোতল ঠিক রেখে! এভাবে বর্তমানে প্রায় ৪০০০ রকম নকল ঔষধ বাজারে চলছে। সরল মনে এসব ঔষধ সেবন করে শরীরে দেখা দিচ্ছে উল্টো প্রতিক্রিয়া। এভাবে অকালে ঝরে পড়ছে অনেক তরতাজা প্রাণ। পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্ট মোতাবেক দেশে বর্তমানে ২৫৮টি এলোপ্যাথিক, ২২৪টি আয়ুর্বেদিক, ২৯৫টি ইউনানী ও ৭৭টি হোমিওপ্যাথিসহ মোট ৮৫৪টি ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে’।
বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রকাশিত স্বাস্থ্য বুলেটিন প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী গত এক দশক ধরে বাজারে যেসব ভোগ্যপণ্য বিক্রি হচ্ছে তার শতকরা ৫০ ভাগই ভেজাল মিশ্রিত। মাছে ফরমালিন ও ফলমূলে হরহামেশা কার্বাইড, ইথাইনিল ও এথ্রিল মিশানো হচ্ছে। কাঁঠাল, লিচু, আপেল, ডালিম, বেদানা, তরমুজ ইত্যাদি বিষাক্ত কেমিকেলে চুবিয়ে উঠিয়ে সপ্তাহকাল তাযা রেখে বিক্রি করা হয়। আম, আনারস, লিচু, পেয়ারা, কলা ইত্যাদিতে মুকুল আসার পর থেকে শুরু করে ৮/১০ বার বিষাক্ত কেমিক্যাল স্প্রে করা হয়। যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। অনেক ব্যবসায়ী শূকরের চর্বি দিয়ে সেমাই ভেজে ঘিয়ে ভাজা টাটকা সেমাই বলে চালিয়ে দেয়। অনেক বেকারীতে পচা আটা, ময়দা, ডিম ব্যবহার করা হয়। অনেক হোটেলে মরা গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী, কুকুরের গোশত ইত্যাদি বিক্রি করা হয়। অনেক ফার্মেসীতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ বিক্রি করা হয়। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য দারুণ ক্ষতিকর।