একটি আত্মহত্যা!
হঠাৎ একটি বিষয় সবাইকে নাড়া দিয়েছে। সেটি হল মহসিন সাহেবের আত্মহত্যা। এই যুগে পারিবারিক বন্ধন ৯০% পরিবারেই নেই। সন্তান তার ক্যারিয়ারের জন্য বাবা মা এর সাথে থাকতে পারে না। অবস্থা এখন শতকরা ৯৭% পরিবারে বিদ্যমান। অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রী ও ছেলে মেয়ের সাথে বিদেশে থাকেন এটাও অনেক পরিবারে দেখা যায়। তিনি নিজেও তাদের সাথে থাকতে পারতেন। এক ছেলে এক মেয়ের পরিবারে বাবা সুখেই থাকার কথা। তার অবস্থান দেখে তাকে আর্থিক অনটনে আছেন বলে মনে হয়নি। তিনি আসলে চরম হতাশাগ্রস্থ হয়েছেন। অনেকটা অভিমানে এই পদক্ষেপ নিয়েছেন। আর আবেগ,হতাশা কিংবা অভিমান এর কোন জবাব নেই। তার ছেলে মেয়ে তাকে খোঁজ নিতে পারে কিন্তু তার সাথে হয়তো থাকা সম্ভব ছিলো না। সেক্ষেত্রে তিনিই বরং তাদের সাথে থাকতে পারতেন। তানাহলে বাসায় তার দেখাশুনা করার জন্য তিনি লোক নিয়োগ দিতে পারতেন। যে ব্যাক্তি নিজেই ছেলেমেয়েদের বিদেশে ক্যারিয়ার গড়ার জন্য নিজের কষ্টের টাকা খরচ করে উন্নত জীবনের জন্য পাঠিয়েছেন তিনি শেষ বয়সে অভিমান করলে কি লাভ হবে। এই সিদ্ধান্ত তিনি তো নিজেই নিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হলো–আবু মহসিন খানের মৃত্যুর জন্য আমরা কেউই কি দায়ী নই? কখন কোন পরিস্থিতিতে একটা মানুষ নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়? মহসিন খানের সুইসাইড নোটে লেখা রয়েছে, ‘ব্যবসায় ধস নেমে যাওয়ায় আমি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। আমার সঙ্গে অনেকের লেনদেন ছিল। কিন্তু তারা টাকা দেয়নি।’ আত্মহত্যা করার আগে ব্যক্তিজীবনের নানা হতাশার কথা তুলে ধরেন তিনি। ‘আমি মহসিন। ঢাকায় থাকি। আমার বয়স ৫৮ বছর। কোনো একসময় আমি ভালো ব্যবসায়ী ছিলাম। বর্তমানে আমি ক্যানসারে আক্রান্ত। তাই আমার ব্যবসা অথবা কোনো কিছুই নেই। ভিডিও লাইভে আসার উদ্দেশ্য হলো, মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং আমার যে এক্সপেরিয়েন্স, সেটা শেয়ার করলে সবাই হয়তো জানতে পারবে। সবাই সাবধানতা অবলম্বন করবে।’
মৃত্যুর আগে ফেসবুক লাইভে মহসিন বলেছেন, ‘কিছুদিন আগে আমার এক খালা মারা গেছেন। তার এক ছেলে আমেরিকায় থাকেন। কিন্তু ছেলেটা আসেনি। এটা আমাকে দুঃখ দিয়েছে, কষ্ট দিয়েছে। আজ আমার আরেক খালা মারা গেছেন। তার তিনটা ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, তারা ঢাকায় আছেন, মায়ের দাফন করেছেন, এটা ভাগ্য। আমার একটি মাত্র ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। আমি বাসায় একা থাকি। খালা মারা যাওয়ার পর খুব ভয় করছে। আমি যদি মরে পড়েও থাকি এক সপ্তাহ, কেউ জানবে না–আমি মরে আছি। করোনা শুরুর আগে থেকেই আমি বাংলাদেশে আছি। একা থাকা যে কী কষ্ট–যারা একা থাকে তারাই বোঝে। আমার এখন পৃথিবীর মানুষের প্রতি কোনো আবেগ নেই। আমি প্রতারিত হয়েছি… পৃথিবীতে একটা জিনিস দেখলাম–ছেলে বলেন, মেয়ে বলেন, স্ত্রী বলেন–কেউ কারও নয়…।’
আবু মহসিন খানের কথাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কথাগুলো বারবার মনের ভেতর নানা প্রশ্ন উসকে দিচ্ছে। আবু মহসিন একজন নামকরা ব্যবসায়ী ছিলেন। ধারণা করতেই পারি, তখন হয়তো তার কাছাকাছি,পাশাপাশি পরিবারের সবাই ছিল। পরিবারে মানুষটার হয়তো অনেক গুরুত্ব ছিল। ব্যবসায় ধস নামার পরই কি তিনি একা হয়ে যান? ব্যাপারটা কি সেই নীতিবাক্যের মতো–‘সুসময়ে বন্ধু বটে অনেকেই হয়, অসময়ে হায় হায় কেউ কারও নয়?’ তাই বলে পরিবারেও এই সত্যটি প্রমাণিত হবে?
মা-বাবার প্রতি দায়িত্বঃ
বয়স্ক মা-বাবা থাকেন গ্রামের বাড়িতে। সন্তানেরা শহরে। ব্যস্ততার কারণে ঠিকমতো খোঁজখবর নেওয়া হয় না। কিন্তু অনেকেই জানেন না, মা-বাবা যখন বৃদ্ধ হয়ে যান, কর্মক্ষম সন্তানদের কাছ থেকে তখন তাঁদের আইনত কিছু প্রাপ্য রয়েছে।
প্রচলিত আইনে বৃদ্ধ মা-বাবা তাঁর সাবালক ও কর্মক্ষম সন্তানের কাছ থেকে প্রাপ্য সম্মান ও ভরণপোষণের জন্য আইনের আশ্রয় চাইতে পারেন। দেশে ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩’ বলবৎ রয়েছে। এই আইনে প্রত্যেক কর্মক্ষম সন্তানকে তার মা-বাবার ভরণপোষণের নিশ্চয়তা দিতে হবে—এই বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোনো মা-বাবার একাধিক সন্তান থাকলে সে ক্ষেত্রে সন্তানেরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে তাদের বাবা-মায়ের ভরণপোষণ নিশ্চিত করবে।
কোনো সন্তান তার মা কিংবা বাবা বা উভয়কে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধনিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে বা আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করতে পারবে না। মা-বাবার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে হবে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা করতে হবে। এমন যদি হয়, মা এবং বাবা আলাদা থাকেন, সে ক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে উভয়ের সঙ্গে আলাদা করে নিয়মিত সাক্ষাৎ করাতে হবে। মা-বাবা স্বেচ্ছায় অন্য কোনো জায়গায় বাস করলে তাঁদের মাসিক বা বার্ষিক আয়ের যুক্তিসংগত অর্থ নিয়মিত প্রদান করতে হবে সন্তানকে।
মা-বাবাকে ভরণপোষণ প্রদান না করলে এবং আইন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন না করলে অভিযুক্ত সন্তানের তিন মাসের জেল অথবা এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হবে। এই আইন অনুযায়ী মা-বাবাকে প্রতিকার চাইতে হলে প্রথম শ্রেণির বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে লিখিত আবেদন করতে হবে। এ আইনের অধীনে অপরাধ হবে আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য এবং আপসযোগ্য। আদালত ইচ্ছা করলে প্রথমেই বিষয়টি আপস-মীমাংসার মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। বিষয়টি ইচ্ছা করলে আপস-নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বার, কিংবা ক্ষেত্রমতো, সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার মেয়র বা কাউন্সিলর কিংবা অন্য যেকোনো উপযুক্ত ব্যক্তির কাছে প্রেরণ করতে পারবে। আদালত থেকে কোনো আপস-মীমাংসার জন্য পাঠানো হলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাক্তি বাবা, মা এবং সন্তান উভয় পক্ষের শুনািন শেষে নিষ্পত্তি করতে পারবে। কোনো অভিযোগ এভাবে নিষ্পত্তি হলে তা আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে বলে গণ্য করা হবে।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক